কৃষিকাজ ও বাগান করতে গেলে পুষ্টিসমৃদ্ধ মাটি প্রয়োজন। মাটির পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য অনেক ধরনের সার ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে কেঁচো সার বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। এটি প্রাকৃতিক এবং সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে তৈরি হওয়া এক ধরনের সার, যা ফুলের গাছসহ অন্যান্য গাছের পুষ্টি সরবরাহে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। এই ব্লগে আমরা কেঁচো সার কীভাবে তৈরি হয়, কীভাবে এটি ব্যবহার করা হয়, এবং এর বিভিন্ন উপকারিতা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করব।
কেঁচো সার কী?
কেঁচো সার, যাকে ইংরেজিতে Vermicompost বলা হয়, হলো এক ধরনের জৈব সার যা কেঁচোর মাধ্যমে তৈরি করা হয়। কেঁচো প্রাকৃতিক উপাদান যেমন পাতা, শাকসবজির খোসা, এবং ফলের বর্জ্য খেয়ে তা হজম করার পর এক ধরনের পুষ্টিকর মাটিতে রূপান্তরিত করে, যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তৈরি হয় এবং কোনো ধরনের রাসায়নিক পদার্থ এতে মেশানো হয় না।
কেঁচো সার কেন গুরুত্বপূর্ণ?
কেঁচো সার মাটির উপাদানগুলির মধ্যে একটি আদর্শ ভারসাম্য বজায় রাখে এবং মাটির গুণগত মান উন্নত করে। যেকোনো ধরনের ফুল, ফল কিংবা শাকসবজি চাষে কেঁচো সার ব্যবহারে পুষ্টির যোগান বৃদ্ধি পায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
কেঁচো সার কীভাবে তৈরি করা হয়?
কেঁচো সার তৈরি করার প্রক্রিয়া সহজ হলেও কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি। সাধারণভাবে, বাড়ির বাগান কিংবা কৃষিক্ষেত্রে এটি সহজেই তৈরি করা যায়।
উপাদানসমূহ:
- কেঁচো (সাধারণত লাল কেঁচো)
- শুকনো পাতা
- শাকসবজির খোসা
- ফলের খোসা
- কাগজের টুকরো (অবশ্যই অজৈব রংবিহীন)
ধাপে ধাপে কেঁচো সার তৈরির প্রক্রিয়া:
১. স্থান নির্বাচন: কেঁচো সার তৈরির জন্য প্রথমে একটি উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন করতে হবে। সাধারণত আর্দ্র এবং ছায়াযুক্ত স্থানে কেঁচোরা ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। বাগানের একটি কোণ বা ছায়াময় কোন জায়গা এই কাজের জন্য আদর্শ।
২. বর্জ্য সংগ্রহ: কেঁচো সারের জন্য ব্যবহার করা হবে প্রাকৃতিক বর্জ্য। উদাহরণস্বরূপ, আপনার বাড়ির রান্নাঘর থেকে সংগ্রহ করা শাকসবজির খোসা, ফলের খোসা, কাগজ, শুকনো পাতা ইত্যাদি।
৩. পাত্রে রাখুন: কেঁচো সার তৈরির জন্য নির্দিষ্ট পাত্রে অথবা মাটির পাত্রে এই সব উপাদান একসঙ্গে রেখে দিন। প্রথমে মাটির একটি পাতলা স্তর দিয়ে শুরু করুন এবং এর ওপরে বর্জ্যগুলি রাখুন।
৪. কেঁচো যোগ করুন: এবার সংগ্রহ করা কেঁচোগুলি মিশ্রণে ছেড়ে দিন। কেঁচো মাটির উপাদান খেয়ে তা হজম করে, এবং তাদের হজম প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় পুষ্টিসমৃদ্ধ সার।
৫. আর্দ্রতা বজায় রাখা: এই প্রক্রিয়ার সময় পাত্রের আর্দ্রতা বজায় রাখা জরুরি। তবে অতিরিক্ত পানি দিলে কেঁচোগুলি মারা যেতে পারে। মাটির আর্দ্রতা ঠিক রাখতে নিয়মিত পানি ছিটিয়ে দিন, তবে মাটির অতিরিক্ত ভিজে যাওয়া ঠিক নয়।
৬. সময়ের অপেক্ষা: কিছু সময় পর, সাধারণত ৪-৮ সপ্তাহের মধ্যে এই মিশ্রণ সম্পূর্ণ পুষ্টিকর সার তৈরি করবে।
কেঁচো সারের উপকারিতা
কেঁচো সার শুধুমাত্র মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে না, এটি গাছের সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং বৃদ্ধিতে অনেক ধরনের উপকার নিয়ে আসে। নিচে কেঁচো সারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা তুলে ধরা হলো:
১. মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি:
কেঁচো সার ব্যবহারে মাটির উর্বরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। কেঁচোরা মাটির জৈব উপাদান খেয়ে তা প্রাকৃতিক পুষ্টিতে রূপান্তর করে, যা মাটির পুষ্টি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
উদাহরণ: গোলাপ গাছের ক্ষেত্রে, কেঁচো সার ব্যবহার করলে এর শিকড় দ্রুত পুষ্টি শোষণ করে, যা ফুলের সংখ্যা ও গুণগত মান বাড়াতে সহায়ক।
২. মাটির গঠন উন্নত করা:
কেঁচো সার মাটির গঠনকে উন্নত করে, মাটির ঘনত্ব কমিয়ে বেশি জল ধারণক্ষমতা সৃষ্টি করে। এতে করে গাছের শিকড় সঠিকভাবে মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারে।
উদাহরণ: টগর ফুলের গাছ কেঁচো সার ব্যবহারে মাটি থেকে পর্যাপ্ত পানি পায়, ফলে শিকড় সুদৃঢ় হয় এবং গাছটি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
৩. গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি:
কেঁচো সার গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কেঁচো সারে প্রচুর পরিমাণে এনজাইম এবং মাইক্রোবিয়াল উপাদান থাকে, যা গাছের শিকড় ও পাতাকে বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে।
উদাহরণ: জবার গাছে কেঁচো সার ব্যবহারে দেখা যায়, শিকড়ের সংক্রমণ কম হয় এবং পাতা সবুজ ও সতেজ থাকে।
৪. ফুলের মান ও সংখ্যা বৃদ্ধি:
কেঁচো সারে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি থাকায় এটি গাছের ফুলের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং ফুলের মানও ভালো হয়।
উদাহরণ: সূর্যমুখী ফুলের গাছ কেঁচো সার ব্যবহার করলে এর ফুলের আকার বড় হয় এবং ফুলের রঙ উজ্জ্বল হয়।
৫. মাটির জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো:
কেঁচো সার মাটির জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়, ফলে গাছের শিকড় দীর্ঘ সময় ধরে আর্দ্রতা পায়। এটি বিশেষ করে খরা-প্রবণ এলাকায় অত্যন্ত উপকারী।
উদাহরণ: কাঁঠাল গাছ কেঁচো সারের মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা বেশি সময় ধরে ধরে রাখতে পারে, যা শিকড়ের বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
৬. পরিবেশ বান্ধব এবং জৈবিক:
কেঁচো সার পরিবেশ বান্ধব এবং সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হওয়ায় এটি মাটির কোনো ক্ষতি করে না। রাসায়নিক সার ব্যবহারের বিপরীতে, কেঁচো সার দীর্ঘমেয়াদে মাটির গুণগত মান উন্নত করে।
উদাহরণ: কেঁচো সার ব্যবহারে রাসায়নিক সার ব্যবহার বন্ধ করে পরিবেশ রক্ষা করা যায়। শিম গাছসহ অন্যান্য গাছের ক্ষেত্রে কেঁচো সার প্রয়োগে ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে।
কেঁচো সার কীভাবে ব্যবহার করতে হয়?
কেঁচো সার ব্যবহারের কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে, যা গাছের বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্যভাবে সাহায্য করতে পারে। কেঁচো সারের কার্যকারিতা বাড়াতে সঠিকভাবে এটি প্রয়োগ করা জরুরি।
১. মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া:
গাছের শিকড়ের সঠিক বৃদ্ধির জন্য কেঁচো সার মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া উচিত। বীজ রোপণের আগে মাটির উপরের স্তরে কেঁচো সার প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং শিকড় দ্রুত পুষ্টি শোষণ করতে পারে।
উদাহরণ: টমেটো গাছের বীজ রোপণের আগে মাটির সাথে কেঁচো সার মিশিয়ে দিলে টমেটোর উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
২. গাছের গোড়ায় ছিটিয়ে দেওয়া:
কিছুক্ষেত্রে কেঁচো সার সরাসরি গাছের গোড়ায় ছিটিয়েও প্রয়োগ করা যায়। এতে করে গাছের শিকড় সরাসরি পুষ্টি শোষণ করতে পারে এবং মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে সুবিধা হয়।
উদাহরণ: তুলসী গাছের গোড়ায় কেঁচো সার ছিটিয়ে দিলে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এর পাতা সবুজ ও সতেজ থাকে।
৩. পানির সাথে মিশিয়ে প্রয়োগ:
কেঁচো সারকে পানিতে মিশিয়ে তরল সার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এই প্রক্রিয়াকে “ভের্মি-টি” (Vermi-tea) বলা হয়। প্রথমে কেঁচো সার একগাদা পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে কয়েকদিন রেখে দিতে হবে। এরপর এই মিশ্রণটি গাছের গোড়ায় কিংবা পাতায় স্প্রে করে ব্যবহার করা যায়।
উদাহরণ: ঘরের ভেতরে রাখা জারবেরা ফুলের গাছে যদি ভের্মি-টি ব্যবহার করা হয়, তবে এর পাতা ও ফুল সুস্থ থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যায়।
কেঁচো সার কীভাবে কাজ করে: বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
কেঁচো সার (Vermicompost) হলো কেঁচোর মাধ্যমে জৈব পদার্থ ভেঙে তৈরি হওয়া এক ধরনের প্রাকৃতিক সার। এটি পরিবেশবান্ধব এবং উদ্ভিদের পুষ্টি সরবরাহে অত্যন্ত কার্যকর। এই প্রক্রিয়াটি কীভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য কেঁচো, তাদের জৈবিক প্রক্রিয়া, এবং সারের রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
১. কেঁচোর জৈবিক প্রক্রিয়া
কেঁচো হলো জৈব পদার্থ ভাঙার একটি প্রাকৃতিক বিশেষজ্ঞ। কেঁচো মাটির ওপর পড়ে থাকা পচনশীল উদ্ভিদ, পশুর বর্জ্য এবং অন্যান্য জৈব উপাদান খায় এবং তা হজম করে। এই হজম প্রক্রিয়ায় কেঁচোর অন্ত্রের ভিতরে থাকা এনজাইম ও ব্যাকটেরিয়া বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
কেঁচোর অন্ত্রে বিভিন্ন রকমের ব্যাকটেরিয়া যেমন Bacillus, Pseudomonas, এবং Nitrobacter সক্রিয় থাকে, যা জৈব উপাদানগুলোকে ভেঙে দ্রুত ছোট ছোট উপাদানে পরিণত করে। এর ফলে মাটি সহজে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে। কেঁচোর অন্ত্র থেকে বের হওয়া পদার্থটি “ক্যাস্টিং” নামে পরিচিত, যা অত্যন্ত পুষ্টিকর ও মাটির জন্য উপকারী।
২. কেঁচো সারের রাসায়নিক গঠন
কেঁচো সার মূলত জৈব পদার্থের ভাঙনের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়, যার ফলে এতে থাকে উচ্চমাত্রার পুষ্টি। কেঁচো সার বিভিন্ন ম্যাক্রো এবং মাইক্রো পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ, যা গাছের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে থাকে:
- নাইট্রোজেন (N): উদ্ভিদের জন্য প্রোটিন গঠনে সহায়ক।
- ফসফরাস (P): ফুল ও ফল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- পটাশিয়াম (K): গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং শিকড়ের বৃদ্ধি উন্নত করে।
- ক্যালসিয়াম (Ca), ম্যাগনেশিয়াম (Mg), সালফার (S): মাটির পিএইচ ব্যালান্স বজায় রাখতে এবং উদ্ভিদের সাধারণ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সহায়ক।
এছাড়া, কেঁচো সার কেঁচোর অন্ত্রে উৎপন্ন হওয়া বিভিন্ন এনজাইম, হিউমিক এসিড, এবং জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ যা মাটির গঠন ও পুষ্টি গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ায়।
৩. মাইক্রোবায়াল কার্যকলাপ বৃদ্ধি
কেঁচো সারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপকারিতা হলো মাটির মাইক্রোবায়াল কার্যকলাপ বৃদ্ধি করা। কেঁচোর হজম প্রক্রিয়ায় মাটিতে বিভিন্ন উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস প্রবেশ করে। এই জীবাণুগুলো মাটির জৈব পদার্থ ভেঙে মাটি থেকে গাছের শিকড়ের জন্য সহজে গ্রহণযোগ্য পুষ্টি তৈরি করে।
মাইক্রোবায়াল ক্রিয়া বৃদ্ধি কীভাবে কাজ করে?
- ১. কেঁচোর অন্ত্রে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া এবং এনজাইম মাটি এবং পচনশীল পদার্থ ভেঙে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে।
- ২. এই মাইক্রোবসগুলি মাটির পোর স্পেস (মাটির ফাঁকা স্থান) বৃদ্ধি করে, যা গাছের শিকড়ের বৃদ্ধি এবং পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়।
- ৩. মাটির আর্দ্রতা ও বাতাস ধরে রাখতে সহায়ক হওয়ায় গাছের শিকড় দ্রুত এবং গভীরে প্রবেশ করতে পারে।
৪. হিউমিক এবং ফুলভিক এসিডের ভূমিকা
কেঁচো সারে প্রাকৃতিকভাবে উপস্থিত থাকে হিউমিক এসিড এবং ফুলভিক এসিড, যা মাটির পুষ্টি ধরে রাখতে সহায়ক। হিউমিক এসিড মাটির কলোয়েডাল গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর ফলে মাটির ভিতরে পুষ্টি উপাদানগুলো আটকে থাকে এবং শিকড় থেকে সেই পুষ্টি দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহৃত হয়। ফুলভিক এসিড গাছের কোষে সহজে প্রবেশ করে এবং কোষের ভেতরে থাকা বিপাক ক্রিয়াকে উন্নত করে।
এই এসিডগুলোর উপস্থিতি কেঁচো সারকে মাটির প্রাকৃতিক পুষ্টি বৃদ্ধিতে সহায়ক করে তোলে। হিউমিক এবং ফুলভিক এসিড মাটির সাথে রাসায়নিক বন্ধন তৈরি করে, যার ফলে মাটির উর্বরতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
৫. কেঁচো সারের প্রয়োগ পদ্ধতি ও বিজ্ঞান
কেঁচো সারের প্রয়োগের কয়েকটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া রয়েছে যা নির্ভর করে মাটির ধরণ, আবহাওয়া, এবং উদ্ভিদের ধরণ অনুযায়ী।
- ১. সরাসরি মাটিতে মিশ্রণ:
এই পদ্ধতিতে কেঁচো সার সরাসরি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। মাটির পৃষ্ঠে কেঁচো সার প্রয়োগ করে মাটির ভিতরে মিশিয়ে দিলে এটি মাটির পিএইচ স্তর নিয়ন্ত্রণ করে এবং দ্রুত গাছের শিকড় পর্যন্ত পুষ্টি পৌঁছে দেয়। - ২. তরল কেঁচো সার (Vermi-tea):
তরল কেঁচো সার গাছের গোড়ায় এবং পাতায় স্প্রে করা হয়। এই সার দ্রুত উদ্ভিদের কোষে প্রবেশ করে এবং দ্রুত ফল দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে তরল কেঁচো সার উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক। - ৩. মাটি পুনর্নবীকরণ:
কেঁচো সার মাটির জৈব পদার্থের ভারসাম্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক। নিয়মিত কেঁচো সার ব্যবহার করলে মাটি দীর্ঘ সময় ধরে উর্বর থাকে এবং রাসায়নিক সারের প্রয়োজন কমে যায়। - ৬. উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, কেঁচো সার উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কেঁচো সারে উপস্থিত থাকা কাইটিনেজ নামক একটি এনজাইম উদ্ভিদের শিকড়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। এছাড়াও, এতে থাকা জীবাণু উদ্ভিদের সংক্রমণ রোধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
উদাহরণ:
বেগুন গাছের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, কেঁচো সার প্রয়োগের ফলে শিকড় ও পাতা সংক্রমণ কমে যায় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি দ্রুততর হয়। কেঁচো সারে উপস্থিত উপকারী ব্যাকটেরিয়া উদ্ভিদের জন্য প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
কেঁচো সার কীভাবে মাটির উর্বরতা বাড়ায়?
কেঁচো সারের প্রধান কার্যকারিতা হলো মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করা। কেঁচো সারের উপস্থিতি মাটির জৈব পদার্থকে ভেঙে ফেলে এবং মাটির পুষ্টি সরবরাহ করে, যা গাছের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
১. মাইক্রোবিয়াল কার্যকলাপ বৃদ্ধি:
কেঁচো সার মাটির মাইক্রোবিয়াল কার্যকলাপকে বৃদ্ধি করে। কেঁচোর হজম প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন হওয়া বিভিন্ন এনজাইম ও ব্যাকটেরিয়া মাটির জৈব উপাদানগুলিকে দ্রুত ভেঙে পুষ্টিকর করে তোলে।
উদাহরণ: সজনে গাছের নিচে কেঁচো সার প্রয়োগ করলে মাটি দ্রুত উর্বর হয়ে ওঠে, যার ফলে সজনে গাছের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যায়।
২. পুষ্টির সরাসরি সরবরাহ:
কেঁচো সার গাছের শিকড়ের কাছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরাসরি পৌঁছে দেয়। এতে করে গাছের শিকড় দ্রুত পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে এবং ফুল বা ফলের উৎপাদন বেড়ে যায়।
উদাহরণ: মরিচ গাছে কেঁচো সার প্রয়োগের ফলে এর শিকড় থেকে সরাসরি পুষ্টি পাওয়া যায়, যা ফলন বৃদ্ধি করতে সহায়ক।
৩. মাটির কাঠামো উন্নত করে:
কেঁচো সার মাটির ঘনত্ব কমিয়ে তার গঠন উন্নত করে। এর ফলে শিকড়ের সঠিক বৃদ্ধি হয় এবং গাছের দীর্ঘস্থায়ী বৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।
উদাহরণ: রজনীগন্ধা গাছের জন্য কেঁচো সার ব্যবহারে মাটির জল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং গাছটি আরও শক্তিশালী হয়।
কেঁচো সার কেন ব্যবহার করব?
কেঁচো সার ব্যবহারের অনেক কারণ রয়েছে, যা একে অন্যান্য সারের তুলনায় আলাদা করে তোলে। এই প্রাকৃতিক সার পরিবেশের উপর কোনো ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে না এবং গাছের জন্য দীর্ঘস্থায়ী পুষ্টি সরবরাহ করে।
১. পরিবেশ বান্ধব:
কেঁচো সার সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং এটি মাটিতে কোনো রাসায়নিক দ্রব্যের প্রয়োজন হয় না। এতে করে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না এবং মাটির জীববৈচিত্র্য বজায় রাখে।
২. দীর্ঘমেয়াদী পুষ্টি:
কেঁচো সার ব্যবহার করলে গাছ দীর্ঘমেয়াদী পুষ্টি পায়। এতে থাকা জৈব উপাদানগুলো ধীরে ধীরে মাটিতে মেশে, যা গাছকে সময় ধরে পুষ্টি সরবরাহ করে।
৩. খরচ সাশ্রয়ী:
যারা নিজে নিজে সার তৈরি করতে চান তাদের জন্য কেঁচো সার অত্যন্ত খরচ সাশ্রয়ী। বাড়ির রান্নাঘরের বর্জ্য ব্যবহার করে এটি তৈরি করা যায়, যা অর্থনৈতিক দিক থেকেও লাভজনক।
৪. গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:
কেঁচো সার ব্যবহারে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। ফলে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন কমে যায় এবং গাছ সুস্থ থাকে।
কেঁচো সার একটি প্রাকৃতিক এবং সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব জৈব সার যা ফুলের গাছসহ অন্যান্য গাছের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, গাছকে দীর্ঘমেয়াদী পুষ্টি সরবরাহ করে এবং গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আপনি যদি প্রাকৃতিকভাবে গাছের যত্ন নিতে চান, তবে কেঁচো সার ব্যবহার অবশ্যই আপনার প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত।
